স্বপ্নের দেশ
ডা. অপূর্ব পন্ডিত
————————————
সকালে টিভি ছাড়াই নিষেধ। তারপরও বাবা টিভি ছেড়ে টুকুন আর মাকে ডেকে নিয়ে বসে।
সুনামির সেকি দৃশ্য। টুকুনের দিনের শুরুটা হঠাৎ পাল্টে গেল।
বাবা জলকম্প হলে কি এরকম হয়?
– কি অবস্থা দেখ এশিয়ার সবগুলো দেশের। একটু ক্ষনের জলকম্প লন্ড ভন্ড করে দিল সব।
কি অবস্থা! টিভির প্রতিটি চ্যানেলে একই কথা একই রকমের দৃশ্য।
ছুটে আসছে জল- সমূদ্র -মানুষ ডুবছে দৌড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করছে। জাহাজটা চৌচির হয়ে চলে এসেছে সাগর তীরের বসতির উপর। খরকুটো নিয়ে কোথাও কোথাও বাঁচার চেষ্টা করছে। লাশ আর লাশ। শুধু ধ্বংসস্তুপ চারিদিকে। এতটুকু পানি নেই অনেক জায়গায় শুধু পানির একটু ক্ষনের তান্ডব হিসাবে সব যেন উল্টে গেছে। জল হয়েছে দ্বীপ। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে পুরো সভ্যতা ।
সমূদ্র চরের মানুষগুলো সবাই কি বাবা এরকম গরীব সব দেশে?
টুকুনের কথায় বাবা নড়েচড়ে বসেন। টুকুনটা সত্যিই চিন্তা ভাবনায় অনেক পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আফসোস হয় মানুষ গুলোর জন্যে।
টুকুনের জন্যে মনে হয় ইস্ টুকুনকে আর একটু সময় দেয়া উচিত।
কম্পিউটারে আঁকাআঁকি করতে করতে বিকেল টা কেটে যায়।
এখন আর গেম খেলে না। সাইকেল রেসিং টা যদিও ভালই লাগে টুকুনের । কিন্তু কেমন একঘেয়েমি লাগে আজকাল। অনেক সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রাস্তায় হরেক রকমের মানুষ। রিক্সা-গাড়ী দেখে। আপন মনে ভাবে কত কথা।
অনেকদিন স্কুল ছুটি। ছুটির দিনগুলো যেন আরও বাজে ।সময় যায় না। এমনিতে তো পড়াশোনা, টিচারের পড়া রেডী করা তারপর দশটা থেকে চারটা পর্যন্ত স্কুলের ক্লাশ – বিকেলে নাস্তা করে টিভির চ্যানেল ঘোরানো রাতে আবার অংক ইংরেজী তারপর ঘুম। আবার সকাল। নাস্তা করে পড়তে বসা। রুটিন হয়ে গেছে।
টুকুন এর বাবা ফারুক সাহেবেরে বেশ বড় চাকরী। হাসিখুশি মানুষ।
টুকুন এর সাথে সখ্যতাও খুব। মাকে যদিও সব কথাই বলে টুকুন তবু বাবার সাথে যেন তার বন্ধুত্ব। পুরান ঢাকার চারতলা বাসার তিন তলায় থাকে ওরা। ছিম ছাম বাসা। একটা বোন থাকলে নিশ্চয়ই দারুন হতো। মাকে বললে মা হাসে অবশ্য গম্ভীর হয়ে যায় সাথে সাথে একটু। বাবার সাথে ওর অনেক কথা হয় দেশের কথা, প্রকৃতির কথা, রাজনীতির কথা। অবশ্য টুকুনের যা বয়স-ফারুক সাহেব কথা একটু রাখঢাক করেই বলেন বোধহয়।খেলাধুলা কিসসা কাহিনী বলতে বাবার কোন কার্পণ্য নেই।
রাজনীতি নিয়ে কথা বাবা পছন্দ করেন না একেবারেই।
টুকুন টেলিভিশনের খবর দেখে দেখে আবার সেগুলো নিয়েই কথা জমে থাকে বেশী।
বাবার সময়ই বা কোথায় এতো তারপরও টুকুনের সাথে সময়তো দেনই।
মা ঘরের কাজে ব্যস্ত সারাদিন। ছুটির দিনগুলোতে টুকুনের মনে হয় যদি বইিরে কোথাও বেড়ানো যেত। বাবার মুখে গ্রামের কথা শোনে টিভিতে গ্রামের ছবি দেখে। মনে মনে গ্রামের কত ছবি আঁকে সে কিন্তু বোঝার মত বয়স হওয়ার পর থেকে কখনো যাওয়াই হলো না গ্রামে।
সেদিন শুক্রবার। বাবা মা টুকুন যার যার কাজে ব্যস্ত। টুকুন পাজেল নিয়ে মেলাতে বসেছে। বাবা অফিসের কি সব কাজে নিমগ্ন। মা খিঁচুড়ি রাঁধছেন। এরকম দিনে খিঁচুড়ি খেতে টুকুনের দারুন লাগে। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। কলিং বেলটা কর্কশ ভাবে বেজে উঠলো। কলিংবেল বাজানোতেও একটা ভদ্রতার বিষয় আছে। বাবা বলেন, দেখবে ভদ্রলোকরা কলিং বেলে খুব সুন্দর করে চাপ দেয়। হালকা চাপ – মৃদু আওয়াজ।
আজকের আওয়াজটা কেমন যেন একটু বেশী কর্কশ।
বাবা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
বৃষ্টিতে ভিজে গায়ে কাঁদা নোংরা জামা কাপড় পড়া একটা লোক সাথে টুকুনের বয়সী একটা ছেলে এসে ঢুকলো ঘরে।মা কেমন যেন ভূরু কুঁচকালেন। বাবা অবশ্য খুব ভদ্রভাবে বললেন
কি হে কাইয়ুম কোত্থেকে এলে?
বিপদে পড়ে এসেছি স্যার আমার ছেলে টা কালু কে আপনার বাসায় কাজে নেবেন?
বাবা কোন উত্তর দিলেন না। চলে গেলেন ভিতরের ঘরে । মার সাথে কথা বললেন। মা চা নিয়ে এলো একটু পর। টুকুন কিন্তু এর মধ্যে দূর থেকেই কালু আর ওর বাবাকে দেখে নিয়েছে। একটু নোংরা কিন্তু— বদমাশ বা চোর টাইপের মনে হয়নি ওর কাছে।
কালুকে রেখে পেট পুরে খিঁচুড়ি খেয়ে চলে গেলেন কাইয়ুম লোকটা।
সেই থেকে টুকুন সাথী পেল কালু কে। টুকুন এর বিছানার পাশে ফ্লোরে তার বিছানা হলো। কালুকে সাফসুতরো করার অভ্যাস করাতে বলেছেন বাবা।
কালুকে পেয়ে টুকুনের কাজও বেড়ে গেল তাই অনেক। কালু বাথরুমে কিভাবে বসবে ।
লাইটের সুইস গুলো কিভাবে অন-অফ করবে, পানির কলটা ছাড়বে কিভাবে।কালুকে পাজেল শিখিয়েছে টুকুন।
একদিন টুকুনতো হেসেই কুটিকুটি কালুকে বলেছিল শাওয়ার ছাড়ার দরকার নেই।কালু বোঝেনি, না বুঝেই হয়তো শাওয়ার ছেড়ে দিয়েছে।
ভিজে একাকার।সেকি চিৎকার তখন। টুকুন ভাই টুকুন ভাই।
ডাইনিং টেবিলে বসে ভাত খাবে সেটাও শেখাতে হয় কাউকে টুকুন আগে বোঝেনি। এর মাঝে কিন্তু দুজনার একটা সখ্যতাও গড়ে উঠেছে । ওর বড় বড় মিকি মাউস, পুতুল গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে।
ইদানিং কালুর চেহারা দেখে চেনাই মুসকীল। টুকুন এর পুরোনো জামা কাপড় গুলো খুব সুন্দর ফিটিং হয়েছে।
মা বাবা ও খুশী। যাক টুকুনের কথা বলার একটা মানুষতো হয়েছে। যদিও খেয়াল রাখতে হয় কালুনা আবার ওর খারাপ অভ্যেসগুলো টুকুনের মধ্যে ঢুকিযে দেয়। এসব বয়সী গ্রামের ছেলেরাতো ডানপিটে।
অনেক সময় গালিগালাজও করে। তবে কালু আসলেই ভাল ছেলে। না করার অভ্যাসই নেই।
মা বাবা ইদানিং কালু এইটা কর-এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও তো কালু। ও দৌড়ে আসে পানি নিয়ে। কদ্দিনেই মিশে গেল সবার সাথে ।
তবে হঠাৎ হঠাৎ কেন যেন কালু কাঁদে। জোড়ে কাঁদে না। লুকিয়ে লুকিয়ে। মা বাবা কেউ খেয়াল করেন নি। টুকুনের চোখ এড়ায়নি।
হঠাৎ করে একদিন সকালে কালু চলে গেল। দরজা বন্ধ করে মা বাবার সে এক তুমুল ঝগড়া। কেন পালালো? খারাপ কোন কথা মা বলেছে কিনা। আগে কখনোই জ্ঞানত এরকম টা দেখেনি টুকুন। মা কাঁদলেন অঝোড়ে।বাবা ফোন করে ছুটি নিলেন অফিসে। সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামের বাড়ী যাবেন। খোঁজ তো করতে হবে কালুর। কোথায় গেল কালু।
টুকুনের মাথায় ঢুকলো সেও যাবে বাবার সাথে। বাবা নেবেন না। টুকুন যাবে। শেষ পর্যন্ত বাবা রাজী হলেন। সন্ধ্যার ট্রেনে রওনা হলো টুকুন আর বাবা।
ট্রেন থেকে নামলো। অজপাড়াগাঁয় ষ্টেশান। সন্ধ্যা হয় হয়। ষ্টেশান থেকে নেমে দুইমাইল হেঁটে যেতে হবে কালুদের বাড়ী। বাবার মুখ গম্ভীর।
চিন্তাক্লিষ্ট। টুকুন তখন খুশী। সে যেন হঠাৎ অন্য এক দুনিয়ায় এসে পড়েছে। টিভিতে , পত্রিকায় ছবি দেখেছে এসবের।
আম, জাম, কাঁঠাল গাছের সারি। মাঝখান দিয়ে মেঠোপথ।
পাখির কলরব। কত কত ছেলেমেয়ে খেলছে দৌড়াচ্ছে পুরো রাস্তা জুড়ে।
রাস্তার দুধারে বড়ই গাছ, কাঁচা বড়ই ঝুলে আছে। একটা ছেলে ইট মেরে বড়ই পারছিল গাছ থেকে। টুকুনের হাতে ধরিয়ে দেয় দুটো।
টুকুন পানি দিয়ে ধুয়ে মুছে নিল। একটু তিতকুটে, টক কিন্তু দারুন লাগে টুকুনের। যেদিক চোখ যায় ধান ক্ষেত, শিম ক্ষেত, মরিচ ক্ষেত। কোথাও কোথাও ছনদিয়ে মানুষের মত বানানো মুখে বড় কালো মত ডেকচি -চোখ-মুখ আঁকা।বাবাকে জিজ্ঞেস না করে পারেনা টুকুন। বাবা বলেন এটা কাকতাড়–য়া।ক্ষেতে অনেক প্রাণী আসে-ফসল নষ্ট করে। এগুলোকে কিম্ভুত মানুষ ভেবে ওরা কম আসে।
রাস্তায় লাইন ধরে কলা গাছ। গাছে কত কত কলার কাঁদি ঝুলে আছে।টুকুন ছুঁয়ে দেখে কলার কাঁদি।
মাঠে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলছে ছেলেগুলো। অনেকেই টুকুনের বয়সী।
টুকুন জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলা যায় জানতই না।
ওর সে কি আনন্দ।
বাবার সাথে কথা বলতে পারছে না বলে ওর যেন আরও ভাল লাগলো। রাস্তায় গাড়ী নেই। ধোঁয়া নেই । ইচ্ছামত ছুটে সামনে যেয়ে বাবার জন্য বসে থাকছে ।বাবা হাঁটছে আনমনে।
সূর্য ডোবাটা যে এতো সুন্দর এতো সুন্দর মেঘলা আকাশের ফাঁক দিয়ে সুর্যটাকে যেন ছুঁয়ে দেয়া যায়।
প্রায় দেড় ঘন্টা হেঁটে চলে এলো কালুদের বাড়ীতে।গ্রামের বাড়ী
দুটো ছনের ঘড়। সামনে উঠোন একটু ভাঙ্গা চোরা তবে আশ পাশ পরিষ্কারই মনে হলো।ঘড়ের চালে লাউ গাছ। বড় দুটো লাউ ঝুলে আছে।
সব শুনশান শুধু কুকুর এক আধটা ওদের দেখে ঘেউ ঘেউ করলো। কালুর বাড়ীর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বাবা ডাকলো কাইউম এর নাম ধরে। কালুর নাম ধরে। কেউ নেই কোথাও। একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করতেই দূরে একটা মাঠ দেখিয়ে দিল।
বাবা টুকুনকে নিয়ে ছুটলেন মাঠে। টুকুনতো মাঠের সামনে যেয়ে অবাক। কালু মাঠের এমাথা ওমাথা দৌড়াচ্ছে। সাথে ৮-১০ জন ছেলে মেয়ে। কালুর চোখ বাঁধা। সবাই মিলে ওকে হেনস্থা করছে।টুকুন ডাক দিল -কালু! কালু চোখের বাঁধন খুলে টুকুনকে দেখে যেন হাতে আকাশ পেল। দৌড়ে এসে জাপটে ধরলো টুকুনকে।
টুকুন ভাই তুমি এসেছ !
কালুর গায়ে তখন রাজ্যের ধুলো। ধূলো কাঁদায় ভরা কালুর শরীরটা যখন টুকুনের সুন্দর জামা টা নষ্ট করে দিল- টুকুনের মনে হলো এই তো জীবন।
এতো ধূলা নয় এ তার দেশের মাটি।কিরে কালু তুই আমাদের ছেড়ে চলে এলি কেন?
টুকুন ভাই তুমি কি এখানে থাকতে পারবে?
টুকুন চুপ থাকে।
আমিও ঢাকায় যেয়ে থাকতে পারবো না। তবে তোমাকে আমি দারুন ভালবাসি টুকুন ভাই।
দুজন দু’জনাকে আরও নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে।
স্বপ্নের পৃথিবীর স্বপ্নের রাজপুত্তুর দুজন যেন মিশে আছে দুজনায়।
এইতো প্রকৃতির সাথে মিশে যাওয়া।
লাল নীল বেগুনীর ক্যামেরার কারুকাজ না সত্যিকারের বাংলাদেশ ।
গ্রাম আর শহরের মিশে যাওয়া।
বাবা হাসলেন তৃপ্তির হাসি।