ডা. অপূর্ব পন্ডিত, ২০ মার্চ ২০২১: প্রতি বছর মার্চ মাসের তৃতীয় শুক্রবার ‘বিশ্ব ঘুম দিবস’ পালন করা হয়। ২০০৮ সালে প্রথমবার এই দিনটি পালন করে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্লিপ মেডিসিন’ এর ওয়ার্ল্ড স্লিপ ডে কমিটি। এই কমিটির মূল উদ্দেশ্য, ঘুমের অভাবে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বিষয়ে মানুষকে জানানো।
বিশ্ব ঘুম দিবস মূলত ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্লিপ মেডিসিনের অর্থায়নে অনুষ্ঠিত বার্ষিক ইভেন্ট।
এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, ‘নিয়মিত ঘুম : স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের অন্তত ১০০ মিলিয়ন মানুষের পর্যাপ্ত ঘুম হয় না। এছাড়া ২২ মিলিয়ন আমেরিকান নিদ্রাহীনতায় ভোগেন।
`খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে?’ খাজনার জোগাড় হয়নি বলেই কি, খোকা থেকে বুড়ো সবারই ঘুমের ডিসটার্ব শুনি আজকাল! এত কাজ কর্ম বেড়েছে, অস্থিরতা বেড়েছে, জীবন থেকে সুখ পালিয়ে গেছে- সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে আমাদের সুন্দর ঘুম। কেউ এসি রুমে আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আপনজনকে পাশে নিয়েও নির্ঘুম কাটিয়ে দেন সারারাত। কেউ আবার এত সুখি, রাস্তার ধারে ইটের উপর শুয়েও কি সুন্দর ঘুমিয়ে যায়। কেউ এমনভাবে ঘুমায়, বাড়িতে ডাকাত পড়লেও ঘুম ভাঙবে না! অনেকে, এমনভাবে ঘুমায়- চোখ খুলে যেন পাহাড়া দিচ্ছে! ভাবুনতো একবার, প্রতিদিন ৮ঘণ্টা ঘুমালে যার বয়স ৯০, সেই মানুষ কিন্তু ৩০-৩৫ বছর শুধু ঘুমিয়েই কাটিয়েছে!
স্বাভাবিক ভাবে ঘুমকে আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি। র্যাপিড আই মুভমেন্ট এবং নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট। নন র্যাপিড আই মুভমেন্টে ঘুমের স্টেজ গুলো হলোঃ স্টেজ এক (হালকা ঘুম) স্টেজ দুই, স্টেজ তিন এবং চার (গভীর ঘুম, ডেলটা ওয়েভ ঘুম), একটা সক্রিয় পদ্ধতি যেটা ৯০ মিনিটের একটি চক্রাকার পদ্ধতিতে চলে। নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট দিয়ে ঘুম শুরু হয় এবং সকালে র্যাপিড আই মুভমেন্ট ঘুমের পর মানুষ জেগে ওঠে। ৮-৯ ঘণ্টা কোন মানুষ একটানা ঘুমায় বলতে বুঝায়, ঘুমের সবগুলো স্টেজ সে পার হয়। তাই বলে সবগুলো স্টেজ একজন পাবে এরকম কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এরমধ্যে প্রথম বার, র্যাপিড আই মুভমেন্ট ঘুম ১০ মিনিট এবং শেষের বার ৬০ মিনিটি পর্যন্ত হতে পারে এবং এই ৬০ মিনিটের সময়টাতেই সাধারণত মানুষ স্বপ্ন দেখে।
ঘুম হলো এমন এক অবস্থা, যখন সে শরীরের ভেতরের পরিবর্তনগুলোতে বেশি রেসপন্স করে। বাইরের পরিবর্তনগুলো সাধারণত: সে খেয়াল করে না।
ঘুমের মধ্যে চলা বন্ধ, খাওয়া বন্ধ, সব কিছু বন্ধ। আসলেই কি সব বন্ধ? কি কি কাজ চলে ঘুমের মধ্যে ! হার্ট চলে, ফুসফুস চলে, ব্রেন কাজ করে – এককথায় শরীরের ভেতরের সব অর্গানগুলো চলে। শুধু মাসকুলার একটিভিটি কমে যায়। বাইরের পারিপার্শ্বিক সব ঝামেলা থেকে সাময়িক মুক্তি আসে।
ঘুম পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণে- স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, উচ্চরক্তচাপ, মাথা ব্যাথা, বেশি বেশি ঘাম হওয়া, মানসিক সমস্যা, কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, পরিপাকের সমস্যা, ডায়বেটিস, স্নায়বিক দূর্বলতা, ওজন বাড়া, যৌনশক্তি হ্রাস সহ, কাজ করতে অনীহা, পড়ালেখায় ভীতি, পরীক্ষায় ভীতিসহ স্বাভাবিক কর্মময় জীবন হয়ে পড়ে দুর্বিষহ ।
ঘুমের সমস্যা প্রায় ৮৪ রকমের। আমাদের জীবনে এমন সময় আসেই- যখন আমরা কোন না কোন ভাবে এসব রোগে আক্রান্ত হই। রাতে ঘুমের মধ্যে হাঁটা, ঘুমে কথা বলা, দাঁত কিড়মিড় করা,ঘুমে ভয় পাওয়া- বিভিন্ন কারণে ঘুমের সমস্যা হয়।
গাড়ী চলছে, বাইরের শীতল হাওয়ার পরশ, গভীর রাত এমন কি দুপুরের ঘুমে, শরীর মন জুড়িয়ে যায়। দুচোখে গাঢ় ঘুম নামে, গাড়ির স্টিয়ারিং সামনে চলে- তারপর এক্সিডেন্ট। জীবনের ঘুম চলে আসে।
সারাদিনের কাজের চাপ, সংসারের নানা চিন্তা-ভাবনা, আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে ঝগড়া ফ্যাসাদ, পরীক্ষার চিন্তা কিংবা বেকার- কোন কাজই নেই, সারাদিনে দু চোখের পাতা এক করার জোগাড় নেই! রাতে বিছানায় শুয়েও হয়তো এপাশ ও পাশ, ঘুম নেই চোখে- ইনসমনিয়া।
তবে কেউ কেউ আছেন, একটু যদি শরীরটা এলানোর সুযোগ হয়- তাহলেই ঘুম। রাজ্যের ঘুম যেন তার দুচোখে। সারাদিনই পড়তে পড়তে ঘুমায়। কাজ করতে করতে ঘুমায়।
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ৮-৮.৪ ঘণ্টা ঘুম পর্যাপ্ত ঘুম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যার মধ্যে ৬-৭ ঘণ্টা রাতের ঘুম, দুপুরে ১-২ ঘণ্টার ঘুম যথেষ্ট। ওজন কমাবে, নিয়মিত ব্যায়াম করবে, জীবনে রুটিন ফিরিয়ে আনবে, অশান্তি কমাবে, হাঁটা হাঁটি করবে, পুষ্টিকর খাবার খাবে, বদহজম কমাবে, এক পাশে কাত হয়ে ঘুমাবে তাতে করে ঘুমের অস্বস্তি অনেকটাই কমে যাবে । যদি তাতেও কাজ না হয়, স্লীপ স্টাডি করে কেমন সমস্যা সে অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে।
ঘুম নিয়ে একেবারেই হেলাফেলা করার সুযোগ নেই। এত ঘুমালে কাজ করবো কখন? সমস্ত ভাবনা ঝেড়ে ফেলে, নিজের কাজ ঠিকমত করার জন্যে, শরীরকে সুস্থ্য রাখতে হলে, পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতে হলেই তো ঘুম হতে হবে নিয়মিত। তাই পর্যাপ্ত ঘুম চাই সবার। সেখানেই শান্তি-সুখ আর সুস্থতা…!
লেখক: সম্পাদক, আমারহেলথ ডটকম।